বাবা দিবস উপলক্ষে বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবার স্মরণে লিখেছেন – জহিরুল ইসলাম টিটু:
‘বাবা’ একটি শব্দ ও দু’টি বর্ণের হৃদয়ের স্পন্দন। বাবাকে নিয়ে যত কথা, যত স্মৃতি সেটি কয়েক কোটি শব্দ দিয়েও পূরণ করার নয়। এইতো কিছুদিন আগেই একচল্লিশ বছরপূর্ণ করে বিয়াল্লিশে পা রাখলাম। একটা সময় বছরের পর বছর বাবার স্নেহ-মমতা আর কড়া শাসনের জালে বন্দি ছিলাম। আদর করলে খুশি হতাম, আর শাসন করলে মন খারাপ করতাম। আজ বুঝি, সেই শাসনটিও ছিল ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
অথচ আজ বাবার স্নেহ-ভালোবাসা আর শাসন করার মতো সেই মানুষটি আমার কাছ থেকে অনেক দূরে, না ফেরার দেশে। হঠাৎ একদিন আচমকা এক ঝড় সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দিল। বন্ধ হয়ে গেল বাবার হৃদস্পন্দন। মাথার উপর থেকে সরে গেল আগলে রাখা সেই বটবৃক্ষটি।
মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে আমাদের ৪ ভাইকে এতিম করে কাঁদিয়ে গেলেন বাবা। দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর চলে গেল। কিন্তু আজও বাবার স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি। বাকি জীবনের জন্য খুঁজে পাচ্ছি আত্মবিশ্বাস। বাবার সাথে আমার জীবনের প্রায় ৩৭ বছরের অনেক স্মৃতি যা হয়তো লিখে শেষ করা যাবে না। আবার কিছু স্মৃতি সারাজীবনের জন্য শক্তি জোগাবে।
আমি গর্ব করি আমার বাবাকে নিয়ে। তিনি এই দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন। তিনি মানুষ গড়ার কারিকর ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি বিজয় নিশান উঁড়িয়েছেন। আমার বাবা মরহুম সিরাজ উল্যা মাষ্টার, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৭১ সালে রণাঙ্গণে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন তিনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে উনার বলিষ্ঠ ভূমিকা সবসময় মানুষের প্রশংসা কুঁড়িয়েছে। এখনো তার সহযোদ্ধারা তাকে নিয়ে গল্প করে, আবার গল্প করে তার ছাত্ররাও। একজন সন্তান হিসেবে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছুই হতে পারে না।
ছোট থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাবার হাত ধরে বড় হয়েছি। যখন বুঝতে শিখেছি তখন সকল আবদারের ভাণ্ডার ছিল বাবা আর মা। আর সন্তানের আবদার পূরণে বাবা-মা ছিলেন সদা হাস্যজ্জ্বল।
বাবার সঙ্গে একটি ঘটনা আজও আমার মনকে নাড়া দেয়। সবেমাত্র যষ্ঠ শ্রেণিতে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি আমি। তখন বাবার কাছে বায়না করেছিলাম একটি বাইসাইকেল কিনে দেয়ার জন্য। সে আবদারও রক্ষা করেছিলেন স্বল্প বেতনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমার বাবা। তখন বুঝলাম বাবা এমনি হয়, নিজেদের শত কষ্টের মাঝেও সন্তানের বায়নাগুলো এভাবেই নিরবে-নিভৃতে পূরণ করে যায়। অথচ কাউকে বুঝতেও দেয় না। আজ আমিও তিন সন্তানের বাবা। আর বাবার মতন করে আমিও তাদের আবদারগুলো পূরণ করতে পারলে আত্মতৃপ্তি খুঁজে পাই।
দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে বাবার কোনো তুলনা ছিল না। আমাদের পরিবারে বাবাই ছিলেন একমাত্র যোগানদাতা। শত কষ্টের জীবন যাপন করেছেন তিনি তবুও কোনপ্রকার অপরাধে জড়াননি। তিনি চাইলে হয়তো রায়পুর বাজারে আমাদের কয়েকটি দোকানও থাকতো। বাবা বলেছিলেন, একসময় রায়পুরসহ সারা বাংলাদেশ থেকে বহু সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ ভিটেমাটি ও নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ভারতে। সে সময় বহু মানুষ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিলেন এদেশে, দখল করে নিয়েছিলেন বহু লোকদের সম্পত্তি। কিন্তু, আমার বাবাকে বারবার লোভ দেখিয়েও রাজি করাতে পারেনি তারা। আমার কাছে আমার বাবা পুরো পৃথিবীর সেরা বাবা। কোনো দিবসে নয়, যতদিন বেঁচে আছি বাবাকে নিয়ে আমার প্রতিটিক্ষণ মধুময় হয়ে থাকবে।
বাবা মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে খুবই পছন্দ করতেন। বাবা বলেছিলেন রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর বিপরীত পাশের মুন্সি বাড়িতে নাকি উনাদের মুক্তি বাহিনীর ঘাঁটি ছিল। দিনের কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ে উনারা সবাই এখানে একসাথ হয়ে প্ল্যানিং করে রাজাকারের উপর আক্রমণ করতেন। একসময় গোয়েন্দাদের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনী জেনে যায় যে, এই বাড়িতে বসেই মুক্তি বাহিনী প্ল্যানিং করে। তাই সে সময় পুরো বাড়িটিকেই জ্বালিয়ে দিয়েছিল রাজাকার বাহিনী। বাবার মুখে শুনে ছিলাম ১১ হত্যার গল্প। বাবার মুখে শুনেছিলাম রাখালিয়ার শহীদ আশ্রাফ আলীর গল্প। বাবার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন রাখালিয়ার ইজাজ কাকা। এছাড়াও বাবার সঙ্গীদের অনেকে আজও বেঁচে আছেন, আবার অনেকেই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। প্রয়াত লক্ষ্মীপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কাজল বাবু, লক্ষ্মীপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সহকারী কমান্ডার আমির হোসেন কাকা, ডাঃ মঞ্জু মামা, রায়পুর উপজেলার সাবেক কমান্ডার মহসিন রেজা কাকা, ছফি উল্যা কাকা, খসরু কাকা। যুদ্ধকালীন সময়ে উনাদের নাকি হাসন্দি, চরবংশী, চরমোহনা, হায়দরগঞ্জসহ রায়পুর-লক্ষ্মীপুরের ভিন্ন ভিন্ন যায়গায় ঘাঁটি ছিল।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমার দেখা:- বাবা বেঁচে থাকাকালীন সময়ে যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন লক্ষ্মীপুর থেকে আমির হোসেন কাকা বারবার আমাদের বাড়িতে এসে বাবাকে বলতেন: সিরাজ আমরা একসাথে যুদ্ধ করেছি, শেখ ফজলুল হক মনি ভাই আমাদেরকে সার্টিফিকেট দিয়েছেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য কিছু একটা করতে চাইছেন। চল আমরা আমাদের কাগজপত্র নির্দিষ্ট দপ্তরে জমা করি। কিন্তু আমার বাবা আমির হোসেন কাকার কথায় তেমন গুরুত্ব দেননি এবং কাগজপত্রগুলোও জমা দেননি। আর এভাবেই চলে গেল অনেকগুলো বছর। হঠাৎ একদিন বাবা ব্রেনস্ট্রোক করলেন, তার প্রায় মাস খানেক পরেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় চলে গেলেন না ফেরার দেশে!
পরবর্তীতে বাবার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ইজাজ কাকা, তৎকালীন লক্ষ্মীপুর জেলা কমান্ডার কাজল বাবু, আমির হোসেন কাকা, ডাঃ মঞ্জু মামা, মহসিন রেজা কাকা, শফি উল্যা কাকাসহ সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় বাবার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাই।
আমার বাবার মৃত্যুতে মা অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছেন। সকলের নিকট আমার মায়ের জন্য আন্তরিক দোয়া চাই এবং দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেওয়া সকল বাবার জন্য দোয়া করি ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানী ছাগীরা’
কমেন্ট করুন